নিজে অভিবাসী হয়েও মেয়রের অভিবাসন বিরোধীতার ইস্যু তুলে ব্রিটেনের সবচেয়ে বাংলাদেশী বহুল এলাকা টাওয়ার হ্যামলেটসে বাংলাদেশী দুই শীর্ষ রাজনীতিকের বিরোধ এবার প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। টাওয়ার হ্যামলেটসের তিন বারের মেয়র লুৎফুর রহমানের সাথে তারই একসময়ের একসময়ের সবচেয়ে ঘনিষ্টজন ডেপুটি মেয়র ও চারবারের কাউন্সিলার অহিদ আহমেদের নানা ইস্যুতে মত দ্বৈততার জের ধরে কাউন্সিলের কেবিনেট থেকে পদত্যাগ করেছেন অহিদ।
গত ১৫ই মার্চ গভীর রাতে টুইট করে কাউন্সিলের কেবিনেট থেকে অহিদের পদত্যাগের পর এ ঘটনা এখন প্রায় এক লাখ বাংলাদেশী অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসে টক অব দ্যা টাউন। রোজার মধ্যে কমিউনিটির বিভিন্ন ইফতার মাহফিলে ঘুরে ফিরে লুৎফুর অহিদের বিষয়টি নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা। বাংলাদেশী কমিউনিটির নেতাদের নিজেদের মধ্যকার বিভক্তি আর কোন্দল অতীতের মত টাওয়ার হ্যামলেটসের বাংলাদেশী কমিউনিটিকে ফের বিভক্ত করার শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশী কমিউনিটির প্রবীনরা।
জানা গেছে, মেয়র লুৎফুর ও অহিদ আহমদ দুজনেই এক সময় লেবার পার্টির রাজনীতি করতেন। দুজনের জন্ম বাংলাদেশে। সত্তরের দশকের ব্রিটেনে বর্নবাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতা বাঙালীপাড়ায় কুমার মুর্শিদ, রাজন উদ্দীন জালালদের পর লুৎফুর রহমান ও অহিদ আহমদই এখন সবচেয়ে জৈষ্ঠ্য ও সক্রিয় ব্রিটিশ বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ। ২০১০ সাল থেকে তারা একসাথে রাজনীতি করেছেন। লেবার পার্টি ছেড়ে লুৎফুর লেবার লিবডেম কনজারভেটিভের সাথে লড়ে স্বতন্ত্র মেয়র নির্বাচিত হন তখন থেকেই লুৎফুর রহমানের পরবর্তী নেতা হিসেবে উত্থান ঘটে দেশে ছাত্ররাজনীতি করে আসা অহিদ আহমেদের। লুৎফুর আর অহিদ সেই ২০১০ সালে মেয়র ও ডেপুটি মেয়র হিসেবে কমিউনিটিতে নিজেদের অবস্থান গড়ে নিতে সক্ষম হন।
২০১৫ সালে মেয়র লুৎফুর কত্থিত দুর্নীতির দায়ে মেয়র পদ থেকে অব্যাহতি ও পরের দুটি নির্বাচনে আদালতের রায়ে অযোগ্য ঘোষিত হন। সে নির্বাচনে তুমুল জনপ্রিয় লুৎফুর উপ-নির্বাচনে সবাইকে অবাক করে নিজের ডেপুটি অহিদকে মেয়র পদে প্রার্থী না প্রার্থী করেন গৃহবধু থেকে রাজনীতিতে আসা অপেক্ষাকৃত আনকোরা রাবিনা খানকে। সে নির্বাচনে রাবিনা লেবার পার্টি প্রার্থী জন বিগসের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। লুৎফুর চলে যান অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে। মনোনয়ন না পেলেও তখন লুৎফুর বলয়ের জৈষ্ট্য একক নেতা হিসেবে কমিউনিটিতে নেতৃত্ব দেন অহিদ।
অন্যদিকে ২০১৮ সালের মেয়র নির্বাচনে রাবিনা লুৎফুরের পক্ষ ত্যাগ করে মেয়র প্রার্থী হন। সে নির্বাচনে লুৎফুর অহিদকে সমর্থন দিলেও আঞ্চলিকতা,মসজিদ ও কমিউনিটির বিভিন্ন সংগঠনগুলোর সমর্থনের সমীকরন সহ নানা কারনে লুৎফুরের ভোট ব্যাংক ভাগ হয়ে যায়। অহিদ পরাজিত হন। যদিও দুদফায় তুমুল জনপ্রিয় লুৎফুরের পুর্ন সমর্থন নিয়েও অহিদ ও রাবিনার পরাজয় নিয়ে বাংলাদেশী মেয়রের ম্যাজিক্যাল চেয়ারটি শুন্য রাখতে চাওয়ার খেলার সন্দেহের সমালোচনা লুৎফুর রহমানকেই সইতে হয়েছে।
২০২১ সালের নির্বাচনে লেবারের জন বিগসকে বিপুল ব্যবধানে পরাজিত করে তৃতীয়বারের মতোন মেয়র হন লুৎফুর। ডেপুটি মেয়র করেন রাজনীতিতে অহিদের অনেক জুনিওর মাইয়ুম মিয়াকে। অহিদকে দেন অপেক্ষাকৃত কম মর্যাদার কমিউনিটি সেফটির দায়িত্ব। তবুও অহিদ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন।
আচমকা গত ১৬ মার্চ ভোরে পদত্যাগের ঘোষনা দেন অহিদ আহমদ। সরাসরি না হলেও মুখ খোলেন লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে। এখনো প্রকাশ্যে না হলেও লুৎফুরের কেবিনেটে কাংখিত পদ বঞ্চিত কাউন্সিলরাও অহিদের সাথে রয়েছেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে মেয়র লুৎফুর রহমানের ঘনিষ্টজনরা বলছেন, হঠাৎ করে পদত্যাগ করার মতোন কোন পরিস্থিতি হয় নি।
জানা গেছে, জন বিগসের পর লেবার পার্টি বাঙালীপাড়ায় বাংলাদেশী প্রার্থী খুঁজছে। রাজনীতির মাঠের একসময়ের বড় ভাই ছোটভাই লুৎফুর-অহিদের সম্পর্ক আগের মতোন নেই নানা কারনে। মেয়র লুৎফুর অপেক্ষাকৃত আরো অনুগত নেতাদের মুল্যায়নের নীতিতে থাকায় হতাশা ক্ষোভ ছিল অহিদ সমর্থিত বলয়ে। অহিদ আসলে লেবার পার্টিতে যোগ দিয়ে আগামী নির্বাচনে লেবারের টিকেটে মেয়র নির্বাচন করতে চান।
এই পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার ৩০ মার্চ অহিদ আহমদ নিউ রোডের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে একান্তে কথা বলেন আমার সাথে। অহিদ বলেন, ২০১০ সালে লেবার পার্টি ক্ষমতায় থাকার সময় সাফোকের সিট থেকে আমাকে এমপির টিকেট দিয়েছিল। ত্রিশ বছর আগে ব্রিটেনের সেক্রেটারী অফ ষ্টেইটের বেতনভুক্ত উপদেষ্টা ছিলাম। লুৎফুর রহমান মেয়র হবার আগ থেকে আমি টাওয়ার হ্যামলেটসের কেবিনেটে ছিলাম। সব ছেড়ে লুৎফুর ভাইয়ের সাথে রাজপথে নেমেছিলাম তার বিরুদ্ধে অন্যায় করা হয়েছিল সে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। কোন ফুলটাইম রাজনীতিবিদ জায়গা বদলাতে চায় না। বাংলাদেশী কমিউনিটির লাখো মানুষের স্বার্থের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে তার সাথে থেকেই রাজনীতি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কে যে কখন লুৎফুর ভাইয়ের বন্ধু আর শত্রু হয় বোঝা মুশকিল। ২০০২ সালে লেবারের মনোনয়ন পাবার পর পাঁচ বার বিপুল ভোটে কাউন্সিলার হয়েছি।
হোয়াটসআপ গ্রুপে অহিদকে লাঞ্চিত করার হুমকির বিষয়ে জানতে চাইলে অহিদ বলেন, যে এই হুমকি দিয়েছে সে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছে, তাই এ ব্যাপারে কথা বলতে চাই না। বাঙালীপাড়ার মুল সমস্যা আমাদের সন্তানদের মাদকাসক্তি। মাদক প্রতিরোধ ও মাদকসেবীদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আমার চেয়ে বেশি আন্তরিকতা নিয়ে কেউ কাজ করে নি। লুৎফুর ভাইয়ের সাথে আমার কোন ব্যক্তিগত বিরোধ না থাকলেও পলিসিগত অনেক দ্বিমত ছিল।
ভাল খারাপ সব কাজে নিঃশর্ত ভৃত্য না হতে পারা যদি অপরাধ হয়, তবে সে অপরাধের দায় মাথা পেতে নেব। লেবার পার্টিতে যোগ দেবার গুঞ্জনের বিষয়টি স্বীকার করে অহিদ বলেন, প্রায় ৪০ বছর ধরে রাজনীতি করি। মানুষই আমার সাধনা। আমার বিরুদ্ধে কোনদিন কোন দুর্নীতি অসচ্ছতা স্বজনপ্রীতির কোন অভিযোগ ছিল না। আমৃত্যু এভাবে থাকতে চাই। আমি তো একা না। টাওয়ার হ্যামলেটসের যারা আমার সাথে আছেন, তাদের সাথে রোজার পরে আলোচনা করে পরবর্তী করনীয় ঠিক করবেন।
অহিদ আহমেদ আরো বলেন, গত কাউন্সিল মিটিংয়ে লেবারের ইমিগ্রেশন মোশন অহিদ আহমেদের টার্নিং পয়েন্ট। তিনি এখনো বিশ্বাস করতে পারছেননা একজন ইমিগ্র্যান্ট হয়ে লুৎফুর এবং এস্পায়ার গ্রুপ কিভাবে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে। নীতিগত কারনে এই মোশনটিকে সাপোর্ট করার জন্য তিনি সকলকে অনুরোধ করেছিলেন। এখন যাই বলুন না কেন সে রাত্রে আমার এস্পায়ার সাথীরা ইমিগ্রেশন মোশনের বিরুদ্ধে ছিলেন। দেখুন বিভিন্ন কাউন্সিল অন্তত লন্ডনের ২১টি কাউন্সিল সরকারের এই নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিলেও ইমিগ্র্যান্ট খ্যাত টাওয়ার হ্যামলেটসের আমাদের এস্পায়ার গ্রুপের এই অবস্থান খুবই হতাশাজনক।
এদিকে টাওয়ার হ্যামলেটসের কেবিনেট থেকে অহিদ আহমদের পদত্যাগের ব্যাপারে মেয়র লুৎফুর রহমানের মন্তব্য জানতে চাইলে তার সাথে ফোনে বার্তা পাঠিয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি।
কেকে/মুনজের