বৃহস্পতিবার | ৩০শে নভেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

তুরস্কে ভূমিকম্প ও আমাদের করণীয়

আবদুল্লাহ হাসান কাসেমি
প্রকাশিত: সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৯:৪৬ পূর্বাহ্ণ

তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে সম্প্রতি আঘাত হেনেছে রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প, যা গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও প্রলয়ঙ্করী। এতে দেশ দু’টিতে প্রায় পাঁচ হাজার ভবন ধসে পড়েছে, হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে, অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে এবং দেশ দু’টির ক্ষতি হয়েছে অপূরণীয়। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্পের আগেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বড় বড় ভূমিকম্প হয়েছে। ১৯৬০ সালে লাতিন আমেরিকার দেশ চিলির দক্ষিণাঞ্চলে ৯ দশমিক ৫ মাত্রার, ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য আলাস্কার প্রিন্স উইলিয়াম সাউন্ডে ৯ দশমিক ২ মাত্রার, ২০০৪ সালে উত্তর সুমাত্রার পশ্চিম উপকূলে ৯ দশমিক ১ মাত্রার, ১৯৫২ সালে রাশিয়া ও হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে ৯ মাত্রার, ১৭০০ সালে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে ৯ মাত্রার, ১৯০৬ সালে ইকুয়েডর ও কলম্বিয়ার সমুদ্র উপকূলে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার, ১৯৫৫ সালে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার এবং ১৯৫০ সালে বর্তমান ভারতের আসাম ও চীনের তিব্বতে ৮ দশমিক ৬ মাত্রার ভূকম্পন হয়েছিল। আমাদের দেশেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। দেশ-বিদেশে এখানে-সেখানে মাঝে মধ্যে এই যে ভূমিকম্প আঘাত হানছে এটি কিয়ামতের অন্যতম আলামত। কিয়ামত যত সন্নিকটে আসবে ভূকম্পনের আঘাত হবে তত বেশি ও প্রচণ্ড।

ভূমিকম্পের অন্যতম কারণ পাপাচার : ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক অন্যান্য দুর্যোগ-দুর্বিপাক কেন সংঘটিত হয়? ভূতত্ত্ব-বিজ্ঞানে এর একাধিক উত্তর থাকতে পারে, তবে মুসলিম হিসেবে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, পাপ ও পাপাচারই তার অন্যতম কারণ। সুদ-ঘুষ, জিনা-ব্যভিচার, হত্যা-লুণ্ঠন, জুলুম-অত্যাচার, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ, শিরক-বিদয়াত, সালাত না পড়া, সিয়াম না রাখা, জাকাতকে জরিমানা মনে করা, হজ ফরজ হওয়ার পরও অবহেলা করা, কুরআন-সুন্নাহর বিধানকে উপেক্ষা করা ইত্যাদি অবাধ্যতামূলক কর্মকাণ্ডের কারণে আল্লাহ তায়ালা ভূমিকম্প ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় পাঠান গাফেল বান্দাদের সাবধান ও সতর্ক করতে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘জলে-স্থলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে মানুষের কৃতকর্মের কারণে, যেন তিনি তাদেরকে তাদের কিছু কৃতকর্মের ফল আস্বাদন করাতে পারেন, এতে করে হয়তো তারা ফিরে আসবে।’ (সূরা রুম-৪১) অন্যত্র ইরশাদ করেন- ‘তোমাদের ওপর যে বিপদ-আপদ আসে তা তোমাদের কৃতকর্মের কারণেই, আর আল্লাহ অনেক গুনাহ মাফ করে দেন।’ (সূরা শূরা-৩০) রাসূল সা: বলেছেন, ‘যখন গনিমতের মালকে নিজের সম্পদ মনে করা হবে, আমানতের খেয়ানত করা হবে, জাকাত দেয়াকে জরিমানা মনে করা হবে, ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছাড়া বিদ্যা অর্জন করা হবে, স্বামী তার স্ত্রীর আনুগত্য করবে, মায়ের সাথে খারাপ আচরণ করবে, পিতাকে বাদ দিয়ে বন্ধুকে আপন করে নেবে, মসজিদে শোরগোল হবে, পাপিষ্ঠ ব্যক্তি সমাজের নেতৃত্ব দেবে। নিকৃষ্ট ব্যক্তি জননেতায় পরিণত হবে, অশুভ পরিণতির ভয়ে মানুষকে সম্মান করা হবে, গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রের বিস্তার ঘটবে, মদ পান করা হবে এবং জাতির উত্তরসূরি পূর্বসূরিদের অভিশাপ দেবে তখন যেন মানুষ অপেক্ষা করে রক্তিম বর্ণের ঝড়, ভূকম্পন, ভূমিধস, রূপ বিকৃতি ও পাথরবৃষ্টির এবং সুতাছেঁড়া তাসবিহের দানার মতো একটির পর একটি নিদর্শনের জন্য।’ (সুনানে তিরমিজি-২২১১)

তাওবাহ ইস্তিগফার করতে হবে : সুতরাং সব ধরনের অন্যায়-অপরাধ, পাপ ও পাপাচারকে ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর দিকে ধাবিত হতে হবে, কুরআন-সুন্নাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরতে হবে এবং ইসলামের বিধিবিধানকে মান্য করতে হবে। সর্বোপরি আল্লাহ তায়ালার দরবারে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হৃদয়ে সব পাপের জন্য আহাজারি-রোনাজারি করতে হবে এবং তওবা-ইস্তিগফার করতে হবে। পাশাপাশি সামনে যেন আর গুনাহ না হয় সে জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। এতে আল্লাহ তায়ালা পাপগুলোকে যেভাবে মোচন করে দেবেন তেমনিভাবে প্রাকৃতিক আজাব-গজবও উঠিয়ে নেবেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আপনি বলে দিন, হে আমার বান্দারা! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ; আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সব গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। তিনিই তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা জুমার-৫৩) অন্যত্র বলেন, ‘অবশ্য যারা এরপরও তাওবাহ করবে ও নিজেদের সংশোধন করবে, (তাদের জন্য) আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।’ (সূরা আলে ইমরান-৮৯) আরেক আয়াতে বলেন, ‘(হে নবী!) আল্লাহ এমন নন যে, আপনি তাদের মধ্যে বর্তমান থাকা অবস্থায় তাদের শাস্তি দেবেন এবং তিনি এমনও নন যে, তারা ইস্তিগফারে রত থাকা অবস্থায় তাদের শাস্তি দেবেন।’ (সূরা আনফাল-৩৩)

অসীম কুদরতের কথা ভাবতে হবে : পাশাপাশি আমাদেরকে আল্লাহ তায়ালার অসীম কুদরত ও মহান ক্ষমতার কথা চিন্তা করতে হবে, কিভাবে কত অল্প সময়ে অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেন এবং কিভাবে আবাদ জনপদ ও জনগোষ্ঠীকে বরবাদ করে দিতে পারেন। তার ইচ্ছার সামনে সর্বাধুনিক সায়েন্স ও টেকনোলজিও একেবারে অক্ষম এবং অপারগ। এ জন্যই তো তিনি ইরশাদ করেছেন- ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্ববিষয়ে পূর্ণ ক্ষমতাবান।’ (সূরা বাকারা-২০) অন্যত্র ইরশাদ করেন- ‘তোমরা যা চাইবে তা হবে না; বরং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যা চাইবেন তাই হবে।’ (সূরা তাকবির-২৯) আরেক আয়াতে ইরশাদ করেন- ‘তার বিষয় তো এমন, যখন তিনি কোনো কিছুর ইচ্ছা করেন তখন বলেন, হও, ফলে সাথে সাথে তা হয়ে যায়।’ (সূরা ইয়াসিন-৮২) বস্তুত বরাবরের মতো তুরস্ক-সিরিয়ার ভূমিকম্পে এটিই প্রমাণ হয়েছে, আল্লাহ তায়ালাই প্রকৃত মহান ও শক্তিধর এবং আমরাই প্রকৃত ক্ষুদ্র ও দুর্বল।

সমব্যথী হতে হবে : সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের আরেকটি বড় করণীয় হলো, ভূমিকম্পে আহত ও নিহত মুসলমানদের জন্য হৃদয়ের গভীর থেকে কষ্ট অনুভব করা এবং তাদের প্রতি জাতীয়ভাবে সমবেদনা প্রকাশ করা। নিহত মুসলমানদের শাহাদাতের জন্য দোয়া করা এবং আহত মুসলমানদের জন্য যথাসাধ্য সহায়তা পৌঁছানোর চেষ্টা করা। কেননা, বর্ণ-গোত্র-ভূখণ্ড নির্বিশেষে বিশ্বের সব মুসলমান পরস্পর ভ্রাতৃত্বের সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘নিঃসন্দেহে মু’মিনরা পরস্পর ভাই ভাই।’ (সূরা হুজুরাত-১০) আরেক আয়াতে ইরশাদ করেন- ‘মু’মিন নর ও মু’মিন নারী সবাই একে অন্যের বন্ধু।’ (সূরা তাওবাহ-৭১) শুধু তাই নয়; বরং এক দেহ এক প্রাণের মতো। রাসূল সা: বলেন, ‘সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও সহানুভূতির ক্ষেত্রে মু’মিনদের দৃষ্টান্ত এক দেহের মতো, যার একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে গোটা দেহ জ্বর ও অনিদ্রায় আক্রান্ত হয়।’ (সহিহ বুখারি-৬০১১) আরেক হাদিসে ইরশাদ করেন, ‘মুসলমানরা যেন একটি সুদৃঢ় প্রাসাদ যার একাংশ অপর অংশকে সুদৃঢ়ভাবে ধরে রাখে।’ (বুখারি-৪৮১)


আরও পড়ুন