রবিবার | ১লা অক্টোবর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ১৬ই আশ্বিন, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

অপরিপক্ক সিদ্ধান্তে তুলকালাম কান্ড; স্কুল কর্তৃপক্ষ বনাম বহিষ্কৃত ছাত্র

দেলাওয়ার হোসেন, জুড়ী
প্রকাশিত: রবিবার, ০১ অক্টোবর ২০২৩, ০৪:২৮ অপরাহ্ন

‘অপ্রীতিকর অবস্থায়’ পাওয়ার অভিযোগ তুলে এক ছাত্র ও এক ছাত্রীকে বহিষ্কার করেছে ফুলতলা বশির উল্লাহ উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার ফুলতলায় অবস্থিত। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষের এই অভিযোগকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে চ্যালেঞ্জ করেছেন বহিষ্কৃত ছাত্র ও তার পরিবার। পাশাপাশি বহিষ্কারের সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ বেআইনী বলেও আখ্যা দিয়েছেন তারা। ঘটনার সূত্রপাত গত ১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবসে।

স্কুল কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে তাদেরকে বহিষ্কার করেছে। বহিষ্কারের চিঠিতে কারণ দর্শাতে গিয়ে তারা লিখেছে, জাতীয় শোক দিবসের সভা চলাকালীন সময়ে সভায় উপস্থিত না হয়ে তারা আনুমানিক ১০:৩০ ঘটিকা থেকে ১২:৩০ ঘটিকা পর্যন্ত বিদ্যালয়ের ৩য় তলা ভবনের ৩য় তলায় অপ্রীতিকর অবস্থায় ছিল। শিক্ষার্থী মারফত এই খবর পেয়ে কয়েকজন শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির কয়েকজন সদস্য সেখানে উপস্থিত হয়ে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হোন। তারপর জরুরী বৈঠকে তাদের দুজনকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং সাথে সাথে তাদের অভিভাবকদের ডেকে বহিষ্কার আদেশ বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

বহিষ্কৃত দশম শ্রেণির ছাত্র ইয়াছিন আলী শামু ও তার পরিবার ১৬ আগষ্ট নিজ বাসায় এক সংবাদ সম্মেলন করেছে। সংবাদ সম্মেলনে বহিষ্কৃত ছাত্র শামু বলে, শোক দিবসের সভা চলাকালীন সময়ে সে সভাস্থলে ছিল। তাছাড়া ঐদিন তৃতীয় তলা ভবন তালাবদ্ধ ছিল। সংবাদ সম্মেলনে শামুর কয়েকজন সহপাঠীও এমন কথাই বলে।

সংবাদ সম্মেলনে শামুর অভিভাবক পল্লী চিকিৎসক খলিলুর রহমান বলেন, “মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আমার ছেলেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আমি অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রমাণ দেখাতে বললে স্কুল কর্তৃপক্ষ বলেন ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ আছে কিন্তু তারা আমাকে তা দেখাতে বাধ্য নন। প্রয়োজন হলে তারা প্রমাণ দিবেন”। পাশাপাশি তিনি বলেন, “সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও গুজব রটিয়ে আমার মেধাবী ছেলের জীবন ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য নুরুল ইসলামের একক কর্তৃত্বে এই কাজ হয়েছে বলে আমার ধারণা”।

অভিভাবকের সংবাদ সম্মেলনের জবাবে পরদিন ১৭ আগষ্ট স্কুলের অফিসে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে স্কুল কর্তৃপক্ষ। সেখানে বক্তব্য রাখেন স্কুলের সহকারি শিক্ষক আতিকুর বেলাল, সেকান্দর আলী, পিংকু চন্দ্র পাল, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বিনয় কুমার শীল, ম্যানেজিং কমিটির সদস্য নুরুল ইসলাম, কমিটির সদস্য কুদ্দুস মিয়া ও স্কুলের সভাপতি মাসুক আহমেদ। স্কুল কর্তৃপক্ষের সংবাদ সম্মেলনে একেকজনের বক্তব্যে একেক তথ্য পাওয়া গেছে। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে ও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন তারা।

সংবাদ সম্মেলনে অপ্রীতিকর অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করলে জবাবে তারা বলেন, শোক দিবসের সভায় উপস্থিত না হয়ে আলাদা এক জায়গায় তারা কথা বলা, ছবি তুলা বা ক্যান্টিনে সিঙ্গাড়া খাওয়া বা যে অবস্থায় থাকুক না কেন সেটাই তাদের কাছে অপ্রীতিকর অবস্থা বলে মনে হয়েছে। তবে ঠিক কোন অবস্থায় তারা ছিল স্বচক্ষে কেউ তা দেখেননি বলে স্বীকার করে স্কুল কর্তৃপক্ষ।

সংবাদ সম্মেলনে স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের প্রধান সাক্ষী এক মেয়েকে হাজির করে। সেই মেয়ে তার বক্তব্যে বলে, “অভিযুক্ত ছাত্র ও ছাত্রী আমাকে জোর করে তাদের সাথে নিয়ে ৩য় তলা ভবনের ২য় তলায় অবস্থিত ক্যান্টিনে যায়। সেখানে বহিষ্কৃত ছাত্র শামু অপর বহিষ্কৃত ছাত্রীর ছবি নিজ মোবাইলে তুলে। তারপর আমাকে ২য় তলায় রেখে তারা দুজন ৩য় তলায় চলে যায়। সেখানে প্রায় ঘন্টাখানেক অবস্থান করে তারা। ভয় পেয়ে আমি তাদেরকে ডাকাডাকি করলে তারা নেমে আসে। তারাসহ আমি যখন নিচে নামতে থাকি তখন হঠাৎ সামনে স্যার-ম্যাডামদের দেখতে পাই”।

সিসিটিভির ফুটেজ সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলে স্কুল কর্তৃপক্ষ বলে তখন বিদ্যুৎ ছিল না। কিন্তু ১৫ আগষ্ট সারাদিন বিদ্যুৎ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে পাল্টা প্রশ্ন ছু্ঁড়ে দিলে স্কুল কর্তৃপক্ষ সাথে সাথে বক্তব্য পাল্টে বলে বিদ্যুৎ থাকলেও স্কুলের প্রিপেইড মিটারে তখন টাকা শেষ হয়ে গিয়েছিল। তবে অপ্রীতিকর অবস্থায় পাওয়ার স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ দাঁড় করাতে পারে নি স্কুল কর্তৃপক্ষ।

১৭ আগষ্টের সংবাদ সম্মেলনে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মাসুক আহমেদ বলেন, “আমি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম না। ফোন কলের মাধ্যমে ঘটনা জেনে সবাইকে পরামর্শ দেই তাদেরকে সাময়িক বহিষ্কার করে পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য। কিন্তু বহিষ্কার আদেশে ‘সাময়িক’ শব্দটি ভুল করে উল্লেখ করা হয় নি৷ আমাদের ধারণা ছিল তাদেরকে সাময়িক বহিষ্কার করার পরে অভিভাবকেরা আবার আমাদের দ্বারস্থ হবেন এবং তারপর তাদেরকে পুনরায় স্কুলে ফেরত আনবো। কিন্তু তা না করে ছেলের অভিভাবক আমাদের সিদ্ধান্তকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে বসবেন আমরা তা ধারনাই করি নি”।

এদিকে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে পুরো জেলাজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। অভিভাবক মহল ও সচেতন মহলে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে৷ যেখানে অপ্রীতিকর অবস্থায় কেউ দেখেন নি বলে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ সেখানে এমন মিথ্যা অভিযোগ তুলে একজন ছাত্র ও ছাত্রীকে বহিষ্কার করার দুঃসাহস স্কুল কর্তৃপক্ষ কিভাবে পায় এমন প্রশ্ন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বহিষ্কৃত ছাত্রী বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জুড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার রঞ্জন চন্দ্র দে বরাবর বহিষ্কৃত ছাত্রের পরিবার থেকে এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চেয়ে লিখিত আবেদন করা হয়েছে। এ ব্যাপারে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, “আমি এ ব্যাপারে একটি অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে”।


আরও পড়ুন